আজ || সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
শিরোনাম :
 


তালায় বঙ্গবন্ধুর চিঠি পাওয়া শহীদ পরিবারের খোঁজ রাখে না কেউ!

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তারা ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। তাদের পরিবার পাচ্ছেন সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা। তেমনি পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারও পাচ্ছেন এমন সুযোগ-সুবিধা। তবে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। যাদের অনেকেই নীরবে নিভৃত থেকে স্থানীয় তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করেছেন এবং নিজ উদ্যোগে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানি দোসরদের কুনজরে পড়ে জীবনও দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার সম্মুখযুদ্ধে শহীদ ও ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পাশাপাশি এমন নিভৃতচারী দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অবদানের কথাও শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করেছেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার এবং পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে চিঠির মাধ্যম ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’ থেকে সারাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদ’ পরিবারকেও আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন।
বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার এবং পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করে আসছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার হিসেবে তাদের ভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেসব ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদ’ পরিবারকে চিঠি দিয়ে সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন ৭৫ পরবর্তী কোনো সরকারই তাদের খোঁজ খবর নেয়নি। যেমনটি হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদ’ ডা. সৈয়দ আব্দুর রবের পরিবারের ক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর দোসর রাজাকারবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা নিজ দোকান থেকে স্থানীয় কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মাঝিয়াড়া গ্রামের (তৎকালীন খুলনা জেলাধীন) পল্লী চিকিৎসক ডা. সৈয়দ আব্দুর রবকে। দু’দিন অমানুষিক টর্চার করার পর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং কপোতাক্ষ নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৭২ সালের ৬ এপ্রিল শহীদ ডা. সৈয়দ আব্দুর রবের স্ত্রী মনোয়ারা খাতুনকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিঠি দিয়ে সমবেদনা জানিয়ে আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন,‘‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশ প্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’ থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের নিকট এক হাজার টাকার চেক প্রেরিত হলো। চেক নম্বর- ০১৩৬৯৮।
শহীদ ডা. সৈয়দ আব্দুর রব ব্যক্তিগত জীবনে দুই বিয়ে করেছিলেন। তার দুই স্ত্রীর ঘরে ৪ ছেলে ও ৬ মেয়ে রয়েছেন। তাদের মধ্যে তার বড় ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহেল বাকী (খসরু) ইতোমধ্যে মারা গেছেন। বাবার রেখে যাওয়া ‘মনোয়ারা ফার্মেসী’ ঘিরেই ছিল তার কর্মব্যস্ততা। তার ছোট (দ্বিতীয়) ভাই সৈয়দ আব্দুল্লাহেল কাফি মনজুও বাবার মতোই হোমিও চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত। স্থানীয়ভাবে যাকে মনজু ডাক্তার নামেই সবাই চেনেন।
এ ব্যাপারে সৈয়দ আব্দুল্লাহেল কাফি মনজু বলেন, ‘২০১২ সালে মারা গেছেন আমার মা মনোয়ারা খাতুন। তার নামেই তালা বাজারে মনোয়ারা ফার্মেসী ছিল। ওই ফার্মেসীতেই বাবা জয় বাংলার পতাকা উড়িয়েছিলেন। সেটি সম্ভবত জুলাইয়ের প্রথম দিকে হবে। এ ঘটনায় স্থানীয় রাজাকাররা খবর দিলে পাকিস্তানী আর্মিরা এসে সেই পতাকা খুলে নিয়ে যায়। তখন আমার বাবা দোকানে ছিলেন না। এরপর ১ আগস্ট স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় দোকান থেকে (মনোয়ারা ফার্মেসী) আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যায় কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পে। সেখানে তাকে দুইদিন অমানুষিক টর্চার চালিয়ে ৩ আগস্ট রাতে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর নাকি তার লাশ পার্শ্ববর্তী কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু ভয়ে কেউ তার লাশটি আনতে যায়নি। পরে স্থানীয়রা সেই লাশ কপোতাক্ষ নদীতে ভাসিয়ে দেয়।’
মনজু আরো বলেন, ‘বাবা ছিলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু নিজেই আমার মাকে সমবেদনা জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। আমার মা-ও হয়তো বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলেন। স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বছর তিনেক আগে আমাদের বিষয়টি বলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমার মাকে লেখা বঙ্গবন্ধুর সেই চিঠিটি খুঁজে পায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা প্রদানসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। আমার বাবাও তো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই আমার মাকে শ^ান্তনা ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। আমরা কেন সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবো? বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতায়। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি অনেক কিছু করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবার হিসেবে তার কাছে আমরা সুযোগ-সুবিধা আশা করি।’ তবে আশার কথা হলো গত বছর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রমে আবেদন করেছেন তিনি।
এদিকে ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদ’ হিসেবে ডা. সৈয়দ আব্দুর রবের পরিবারকে প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন বৃহত্তর খুলনা জেলা বি,এল,এফ (মুজিব বাহিনী) প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু ও তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মফিজ উদ্দীনসহ সংশ্লিষ্টরা। তাদের দেয়া এসব প্রত্যয়নপত্রে বলা হয়েছে,‘শহীদ ডা. সৈয়দ আব্দুর রব মুক্তিযুদ্ধের সময় তালা বাজারে নিজ দোকানে (মনোয়ারা ফার্মেসী) জয় বাংলা তথা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তিনি ছিলেন তালা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি, একজন সমাজ সেবক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর দোসর রাজাকারবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা তার দোকান থেকে ধরে নিয়ে স্থানীয় কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পের পার্শ্বে কপোতাক্ষ নদীতে গুলি করে লাশ ভাসিয়ে দেয়।’
তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদ্য বিদায়ী কমান্ডার মোঃ মফিজ উদ্দীন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে উনার সরাসরি ভূমিকা কতটুকু ছিল সেটি আমার জানা নেই। তবে রাজাকাররা উনাকে হত্যা করেছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদ’ হিসেবে তার পরিবারকে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়েছে।”


Top